লোকটা

তখনও চশমাটা পড়েনি লোকটা। ভোরের আধো-অন্ধকারে আয়নায় অস্পষ্ট অথচ ভীষণ চেনা একটা মুখ। রোজই আলগোছে নজরে পড়ে যায়, বাথরুমের আয়নায়, জানলার কাঁচে, গাড়ির গায়ে, আয়নায়, আরও কত কী-তে। কিন্তু তখন মন অন্য চিন্তায় ব্যস্ত থাকে। নজর করে না। যখন সত্যিই নজর করতে বসে,  তখন কিন্তু কোনও মিল পায় না নিজের সাথে। এই বুড়োটে, হিংসুটে মুখটা অতি পরিচিত, কিন্তু নিজের বলে বিশ্বাস হয় না। এর সাথে যেন লোকটার ইমেজটা খাপ খায় না। বিট্রে করে মুখটা। লোকটা দেখতে ভালো। সবাই বলে। লোকটা নিজেও জানে। জানে বলেই এই দিনগুলোয় ভীষণ রাগ হয় আয়নার দিকে তাকিয়ে। আজও সেরকম একটা দিন। এই দিনগুলো বলে কয়ে আসে না। হঠাৎ হাজির হয়ে গোটা দিনটা নষ্ট করে দেয়। সবার ওপর রাগ হয় তখন। আজও হবে। কিন্তু আজ একটা বিশেষ দিন। লোকজন এড়ানো যাবে না কোনওমতেই। অবশ্য এমনিতে লোকজন পরিবৃত হয়েই থাকতে ভালোবাসে লোকটা। মধ্যমণি হয়ে থাকার লোভ প্রচন্ড। না, ঠিক লোভ না, কিরকম একটা প্রয়োজনীয়তা। শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য হাওয়ার মতই দরকার হয়। সেটা আদায়ও হয়। কিন্তু এই দিনগুলো এলেই আর মাথার ঠিক থাকে না। না না, মাথার ঠিকভুল না, মাথা ঠিকই থাকে। ইন ফ্যাক্ট এই মাথার জোরেই এতগুলো লোককে আজও ধরে রেখেছে নিজের চারদিকে। নইলে এই ৬৪ বছর বয়সে কজনই বা লোকটার মত পাত্তা পায়? আজ সেই ৬৪ বছর পূর্ণ হবার দিন। আজকের দিনটা এইভাবে শুরু না হলেই ভালো হত।


লোকটার বউ খুব ভালো। অবশ্য বউ নেই আর। গিন্নী হয়ে গেছে। রোজ ভোরে উঠে বেড টি করে দেয়। আজ উঠে পাশে না পেয়ে খোঁজ নিয়ে গেল বাথরুমের বাইরে থেকে হেঁকে। টিকতে দেবে না কোথাও শান্তিতে। লোকটা বিরক্ত হয়ে বাইরের ঘরে গেল। লোকটার বউ আনস্মার্ট। গাঁইয়া। জন্মদিনে উইশ করাকরি শেখেনি আজও। তবে মনে করে পায়েস করে-টরে। আরও চর্ব্যচোষ্য রাঁধে-বাড়ে গোটা দিন ধরে। রাতে গুষ্টির লোক এসে খায়। তাদের সাথে বিশেষ কথা-টথা বলে না। বলতেও পারে না অবশ্য। এরা সবাই লোকটার পরিমন্ডলের মানুষ। লোকটার মত বুদ্ধিজীবী মহলের লোক। অন্তত ভানটা সেরকমই। লোকটা বিদেশে থাকে, লন্ডনে। সেখানে বাঙালি গোষ্ঠীর পরিচিতরা আসে লোকটার জন্মদিনে। কবে থেকে যেন এরা এটা চালু করে ফেলল। আগে আরও লোক আসত। এখন কমে এসেছে। তবে এরা লোকটার প্রিয়পাত্র নয়। লোকটাও এদের প্রিয়পাত্র নয়। তবে হবার ইচ্ছে হয়। খুব ইচ্ছে হয়। সেই ইচ্ছেটা ভানের মাধ্যমে পূর্ণও হয়। কিন্তু সত্যিকারেরটা পাওয়া হয় না। সে তবু বরং পাওয়া যায় দেশে গেলে, কলকাতায়। ওরা লোকটাকে ফেসবুকেও রোজ মাথায় তুলে রাখে। প্রায় প্রত্যেকেই ভাবে লোকটা তার বন্ধু। কিন্তু ওরাও কেউই লোকটার বন্ধু নয়। ওদেরকে বন্ধুর সম্মান দেবার প্রশ্নই ওঠে না। ওরা স্তাবক। স্তাবক কখনও বন্ধু হয়? লোকটার কোনও বন্ধু নেই। সমকক্ষ কাউকে পেলই না, বন্ধু হবার মত। না না, পেয়েছে। মাঝে মাঝে সন্ধান পেয়েছে যোগ্য লোকের। এই লন্ডনেই এসেছে তারা, দুর্গাপুজোয় অনুষ্ঠান করতে। আলাপ হয়েছে। কখনও টিভিতে বা খবরের কাগজের মাধ্যমেও চিনেছে কারুকে। লোকটার বারবার মনে হয়েছে, এদের সাথে কথা বললে এরা লোকটাকে বুঝবে, লোকটার যোগ্য মর্যাদা দেবে।  কিন্তু তারা বিখ্যাত মানুষ, সেলেব যাকে বলে। তারা তো সব সাপের পাঁচ পা কেন, দশ পা অবধি দেখে ফেলেছে। তাও তাদের কাছে আত্মসম্মানের মাথা খেয়ে গেছে লোকটা। বারবার। ওরা পাত্তা দেয়নি।


ব্রেকফাস্ট করে দিয়েছে বউ। লুচি আর আলুর সাদা তরকারি। গরম গরম খেতে হবে বলে এটা একসাথে খাওয়া যায় না। ভালো হয়েছে। আজকে দিনটা খারাপ যাবে বোঝা হয়েই গেছে, এখন বউয়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না লোকটার। লোকটা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিজের স্টাডিতে ঢুকে গেল। ল্যাপটপের কালো স্ক্রীনে আবার হিংসে মেশানো বার্ধক্য চোখে পড়ে গেল। কেন এরকম দেখায় লোকটাকে? কী নেই লোকটার? গাড়ি, বাড়ি, টাকা, স্তাবক। বন্ধু নেই অবশ্য। কিন্তু বন্ধু দিয়ে কী হবে? বন্ধুর দরকার নেই লোকটার। কিন্তু তাহলে কী? কী চাই এই মানুষটার, যে এরকম হিংসুটে আক্রোশে তাকিয়ে আছে ওর দিকে? লোকটা আর সকলকে, এমনকি নিজের মনকেও চোখ ঠেরে জীবনটা কাটিয়ে ফেললেও, এই মুখটার সামনাসামনি হলেই স্বীকার করতে বাধ্য হয় — লোভটা প্রতিপত্তির। দশজনের একজন হওয়ার; মান্যগন্য ব্যক্তি হয়ে ওঠার। ওই সেলেবকুলের একজন হয়ে ওদের মুখে ঝামা ঘষে দেবার। কম চেষ্টাই কী গেছে তার পেছনে? কী না করেছে লোকটা। দান-ধ্যান-লেখা-আঁকা-গান-ছবি-তোলা-ডকুমেন্টারি। সব চেষ্টা করা হয়ে গেছে। এ তোমার ফেসবুকে দুদিনের শৌখিন মজদুরি নয়। রীতিমত বই লিখে ছাপিয়েছে লোকটা। ছবি এঁকে, তুলে, প্রদর্শনী করেছে। গান গেয়ে সিডি বের করেছে, ফ্রীতে বিলিয়েছে চেনা পরিধিতে। ডকুমেন্টারি বানিয়েছে গ্রাম-বাংলার — পশ্চিম বাংলা তথা বাংলাদেশের। আর্থিক সাহায্য করেছে কত বাংলার গ্রামেগঞ্জে। সঙ্গী শুভার্থীরা ভিডিও করেছে। ইউটিউবের অন্ধকার কোণে পড়ে থাকে সেসব। কেউ দেখার নেই, বোঝার নেই। নিজেই মাঝে মাঝে ডেকে ডেকে দেখানোর ফলে এই স্তাবকগুলো জুটেছে ফেসবুকে। তবু মোমেন্টাম আসে না। এসব শেয়ার হয় না, প্রচার হয় না। লোকটার প্রতিভা কেউ চিনতে পারে না। কতগুলো ভালো ভালো শুনতে কথাই সার। লোকটার সেলেবত্বের আর টেক-অফ হয় না।


এদিন লাঞ্চের সময় মেয়ে-জামাই আসে লোকটার। কিন্তু তাদের মুখদর্শনের ইচ্ছে নেই এখন। তবু, সামাজিকতা। স্টাডি থেকে বেরিয়ে নিচে এল একতলায়। মেয়ে-জামাই এসে বসে আছে বসার ঘরে। খবর দিচ্ছে ফোটোগ্রাফার  জামাইয়ের উন্নতির। মেয়ের হাতে একটা ট্যাব। তাতে ছবি দেখিয়ে জানাচ্ছে কোন ছবির জোরে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে চাকরি পেয়েছে জামাই। ওরা খবরটা চেপে রেখেছিল আজ এসে জানাবে বলে। জামাই বিনয়ের অবতার সেজে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু খুব উপভোগ করছে। প্রচন্ড রাগ হল লোকটার। এইটাই লোকটা কবে থেকে চেয়ে আসছে। এইটাই পাওয়া হল না আজও। গুনে গুনে ৬৪ বছর কেটে গেল এইটার খোঁজে। ৩৫ বছরের মধ্যেই ওর জামাই সেটা পেয়ে গেল। আর আজ, লোকটারই বিশেষ দিনে, লোকটার যেটুকু পাত্তা জোটে, সেটুকুও হাইজ্যাক করে, লোকটার নিজেরই বউ-মেয়ে-জামাই লোকটার অ্যাটেনশন কেড়ে নিতে উদ্যত। এসব বরদাস্ত করবে না লোকটা। বসার ঘরে না ঢুকে ফেরত উঠে শোবার ঘরে ঢুকে গেল লোকটা। ভ্যালিয়াম, অ্যালজোলাম, দুটোই আছে। ফার্মাসিস্ট  হবার এই এক সুবিধে, ডোজে খুঁত হবার ভয় নেই।


★               ★                ★


ঘুম ভাঙল লোকটার। কটা বাজে? গলা শুকিয়ে কাঠ। একটা নার্স এগিয়ে এল। জল চাইল লোকটা। নার্স বলল সম্ভব না। বেরিয়ে গিয়ে লোকজন ডেকে আনল। লোকটার তিন নিকটাত্মীয়। চোখে চশমা নেই আবারও। মনে হল কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলে গেছে মেয়ে-বউয়ের। জামাইটা গম্ভীর। কোনওমতে ঘাড় ঘুরিয়ে ঝাপসা চোখে জানলার বাইরে তাকাল লোকটা। আলো ফুটছে, না কমছে? যাই হোক, জন্মদিনটা আর মাটি করার উপায় নেই কারুর। এরা ভেবেছে ও মরতে চেয়েছিল। হাস্যকর। ব্যাঁকা হাসি হাসল লোকটা। জানে, এরকম হাসলে খুব খারাপ দেখায় ওকে। তাও। বউ, মেয়ে, জামাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।
যদি ভাল্লাগে...email-এ sign up করতে পারেন/পারো/পারিস, নতুন লেখা ছাড়া কিচ্ছু পাঠাবো না, promise...