আমি তখন সবে মাধ্যমিক দিয়েছি। টিপিকাল বাঙালির মত আমারও ওই তিন মাস বিবিধ টিউশনে দৌরাত্ম্যি করেই কাটছে। আমার বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা ভয়ানক সীমিত। তার ওপর তারা কেউ আশেপাশে থাকেও না। মেয়েদের স্কুলে পড়তাম বলে তারাও সবাই মেয়ে। তার মধ্যে আমি একটু বেশি ঘরকুনো। সব মিলিয়ে ঘরে-বাইরে ইমেজটা এক্কেবারে নিরীহ গোবেচারা। এমনিতে বাবা-মা-ভাইয়ের ওপর দিব্যি দাপট চলে ঠিকই, কিন্তু সেসব সামান্য টিভি, কম্পিউটার, গল্পের বই কেন্দ্র করেই। আর মাঝেমধ্যে ওই ছুটির তিনমাস পড়াশোনা ত্যাগ করার মৌলিক অধিকারের দাবিতে। এর বেশি কিছু নিয়ে কথা বলার আমার দরকারই পড়ে না। এই নিরীহতার সুবিধে হল বাড়ির যে টিউশন ছাড়া একা বেরনোর নিষেধাজ্ঞা ছিল এবং পড়তেই যে যাই সেটা যাচাই করতে যে ওরা আনতে যাবার নিয়ম রেখেছিল, সেটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। তাই অবলুপ্ত না হলেও শিথিল নিয়মরক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এই সময় আবিষ্কার করে বসলুম অনলাইন চ্যাটের নেশা। এমনিতে যেহেতু লাজুক, লোকজনের সান্নিধ্যে উশখুশ করি আর এড়িয়ে চলি, কথাও কম বলি, তাই বাড়ির জনগণ আমার পাখনা গজানোর প্যাটার্ন সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাটুকুও করে ওঠার সুযোগ পায়নি। এদিকে আমিও ইন্টারনেটে উত্তরোত্তর বন্ধু সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেছি। আর এত কান্ড যে হয়ে যাচ্ছে বাড়ির কেউ টেরও পাচ্ছে না। শেষে এমন হল যে ওইটাই সারাদিন চলছে, মাঝেমধ্যে বেরিয়ে এসে খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, পড়তে যাচ্ছি। তার ওপর লোকে বিশেষ টের না পেলেও বয়সে বড় বড় (একজন তো পাক্কা ১০ বছরের বড়) তুতো-দাদাদের আশপাশে বড় হওয়ায়, রীতিমত অকালপক্ব তৈরি হয়েছি, ফলে আমার তখন চ্যাটের বন্ধুরা সব কলেজ-পড়ুয়া। আবার অনেকেই ছেলে। বড়দের তৈরি করা সমস্ত নিয়ম তাদের চোখের ওপরেই চুরমার হয়ে যাচ্ছে। অথচ কেউ জানতেও পারছে না। বড়দের সবথেকে প্রিয় যে কাজ - ছোটদের আনন্দ করা আটকানো – আমার প্রতিটা দিন মনে মনে সেটার বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ হয়ে দাঁড়াল। আমার তো মাটিতে পা-ই পড়ে না! শেষে মনে হল একা বেরোতে না পাওয়ার নিয়মটাও ভাঙব। অনেকদিন ধরেই চ্যাটের বন্ধুরা সব মিট-ফিট করে, আমি ভাবলাম আমিও করব।
বাড়ির কাছেই পাথফাইন্ডার। সেখানে বেস্পতিবার বাংলা-ইংরিজি পড়ি। ওইদিন বিকেলেই ফাঁদলুম। সকাল থেকে ভয়ে, উত্তেজনায় গলা দিয়ে খাবার নামছে না। দুপুর গড়ালো। বিকেল হল। অপরাধী মনে আমি যাই করছি, মনে হচ্ছে মা যেন বেশি করে নজর করছে। মা কিছু বললেই বুকে হাতুড়ি পড়ছে। হৃদপিন্ডটা গলায় ঠেলে উঠে আসছে। কানে কম শুনছি। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। শেষে থাকতে না পেরে কোনও মতে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। জীবনে প্রথমবার একা কোথাও যাব। মনে হচ্ছে রাস্তার প্রতিটা লোক আমায় দেখেই বুঝে ফেলছে আমি ক্লাস কাটব। ওইতো পানের দোকানের সুবীরদা দেখে ফেলল। ও কী বুঝে ফেলেছে? ও কী বাবাকে বলে দেবে? টেনশনে ভাবলাম পাথফাইন্ডারেই চলে যাই। যেই ভেবেছি, দেখি সব ভয় চলে গেল। আর কেউ দেখছে বলে মনে হল না। আবার সাহস বাড়ল। মেট্রো স্টেশনটা দেখে মনে হল এতটাও ভয়ের কিছু নেই। এখানে আর চেনা কেউ আছে বলে মনে হয় না। নিজেকে বোঝালাম, এভাবে মিনমিনিয়ে জীবন কাটানোর কোনও মানেই হয় না। নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছলাম। দেখাও করলাম। উত্তেজনায় কথা কানেও বিশেষ ঢুকছে না। আড্ডায় মন নেই, শুধু নিজের সাহসের বহর দেখেই আমি উত্তেজিত। একাজ নিশ্চয়ই সবাই করেছে জীবনে, রোজই করে। আজও অগুনতি লোক করছে সারা শহরে, পৃথিবীতে। কিন্তু আমার তো সেই প্রথম! আমি প্রতিটা মুহূর্তকে খেয়াল করে গিলছি রীতিমত।
দেখতে দেখতে সন্ধে সাড়ে সাতটার সময় আড্ডা লাটে উঠল। ভালোই হল। চাপা টেনশনে কানে কথাই ঢুকছিল না। কিন্তু পড়লাম মহা ফাঁপড়ে। সাড়ে সাতটায় তো ছুটি হয় না। আমায় তো ঠিক সময় মত পাথফাইন্ডারের সামনে হাজির হয়ে ভালমানুষটি সেজে বাবার অপেক্ষা করতে হবে। সে তো সাড়ে আটটার আগে কোনওমতেই না। কী করি? এক বন্ধু বলল হেঁটে হাজরা যেতে রাজি অছি কিনা। আমি এক পায়ে খাড়া! যদি এইভাবেও কিছুটা সময় কাটে। এদিকে বৃষ্টি পড়ছে। আমার ছাতা নেই। ভিজে ভিজে আটটায় হাজরা পৌঁছলুম। ততক্ষণে বৃষ্টি ধরে গেছে। আর তো কিছু করার নেই। আরেকজন তো নিজের পথে হাঁটা দিল। আমি ভাবছি কী করি। কাঁচা বুদ্ধিতে ফোন করলাম বাবাকে। বললাম ছুটি হয়ে গেছে। বাবা অবাক। জিজ্ঞেস করল কেন। বললাম আমি জানি না, হয়ে গেল, ছেড়ে দিল। ইতিমধ্যে ভিজে জামার কথা ভুলে গেছি। বাবা বলল দাঁড়াতে কিন্তু আমি বললাম চলে আসছি। বিশেষ করে বললাম বেশি তো রাত হয় নি। কাজটা কাঁচা হচ্ছে বুঝতেই পারলাম না। এখন ভাবলেই আফসোস হয়। বাবা একটু ভেবে বলল চলে আয় সাবধানে। ব্যস আমিও বাড়িমুখো হাঁটা দিলাম।
বাড়ি ফিরলাম। বাবা আবার জিজ্ঞেস করল কেন ছেড়ে দিল। পাপী মন তো, বেশ রেগে ঝাঁঝিয়ে বললাম আমি কোত্থেকে জানব! দেখলাম মা বাড়িতে নেই। বেড়িয়েছে। বাবা কিছু না বলে জিজ্ঞেস করল ভিজলি কী করে? আমি মুহূর্তে কাঠ। তারপরে একটু সামলে উঠে যথাসম্ভব তাচ্ছিল্যের সাথে তোয়ালে দিয়ে মাথাটা মুছতে মুছতে মুখটা লুকিয়ে বললাম বৃষ্টিতে। বাবা বলল সে তো জানি কিন্তু বৃষ্টি তো তুই ফোন করার আগেই ধরে গেছিল। অপরাধী চিত্তে মনে হল থার্ড ডিগ্রী জেরা চলছে। খুব রেগে বললাম একটু আগেই আবার পড়ছিল ঝিরঝির করে, তুমি দেখ নি। এসব জিজ্ঞেস করার কী আছে, মানুষে ভেজে না? বাবা হঠাৎ খুব নিরীহ হয়ে পাশে এসে বলল সত্যিই ক্লাসে গেছিলি? আমি ঘাবড়ে গিয়েও সামলে নিলাম। দেখলাম আমায় বুঝিয়ে সুঝিয়ে কথা বের করিয়ে নিতে চাইছে। স্রেফ প্রমাণ ছাড়াই অপরাধ স্বীকার করিয়ে নিতে চাইছে। ব্যাপারটা বুঝে ফেলেই খুব গর্ব হল। হুঁ হুঁ বাওয়া, ভেবেছ কী! এতই সোজা! তুমি ডালে ডালে চললে আমি পাতায় পাতায় চলি। এত ফেলুদা, ব্যোমকেশ, শার্লক হোমস কী এমনি গুলে খেয়েছি নাকি। ভয়ানক অভিমান ফলিয়ে তক্ষুনি বললাম যে এইভাবে ইনোসেন্ট মানুষকে সন্দেহ করেই অপরাধী বানিয়ে ফেলা হয়। যদি দোষ না করেই দোষী হতে হয় তাহলে দোষ করে নেওয়াই ভাল, ইত্যাদি, ইত্যাদি। বাবা আবারও বলল, বল না, সত্যি কোথায় গেছিলি, আমি কিছু বলব না। আমি জানি তুই ক্লাসে যাসনি। আমারও রোখ চেপে গেল। ততই বলতে লাগলাম যে প্রমাণ কী যে যাইনি? কেন এভাবে আমায় মিথ্যেবাদী সাজানো হবে! শেষে বাবা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল যখন আমি ফিরছি, বাবা তখন পাথফাইন্ডারে ফোন করেছিল কেন ছেড়ে দিয়েছে জানতে।
শুনেই মনে হল এক্ষুনি মরে গেলে ভাল হয়। প্রত্যেকটা ডেঁপো আস্ফালন মনে পড়তে লাগলো আর মনে হল মাটিতে মিশে যাই। কিন্তু ১৬ বছরের ডাঁট তো, অত সহজে ভাঙে না। হারতে নেই কিছুতেই। সঙ্গে সঙ্গে বলে বসলাম যে ঠিক এইভাবেই আমায় অবিশ্বাস করে পাথফাইন্ডারে ফোন করে বলেই আমার বিশ্বস্ত হতে ইচ্ছে করে না। বাবা আর জোর করল না। শুধু বলল কোথাও গেলে যেন বলে যাই, এভাবে গেলে চিন্তা হয়। প্রচণ্ড একটা ঝামেলা অনুমান করে ভাবলাম এবারে কিছুতেই এসব সহ্য করব না। খুব ঝাঁঝিয়ে বললাম যে সেটা করতে পারলে কী আর এত কষ্ট করতে হত! কিছু না বলে বাবা উঠে খবর দেখতে বসে গেল। খুব চিন্তায় পড়লাম। বকল না তো কই? চেঁচামেচি হবে একটা, ভেবে মনটাকে শক্ত করছিলাম, কোনও প্রয়োজনই হল না। তবে কী মা ফিরলে মাকেই বলে দেবে? সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গেলাম নির্ঘাত তাই। জানা কথাই যে মা শাসন করে বেশি। আর বিবিধ নিষেধাজ্ঞা জারি ও তার যথাযথ পালনের দায়িত্বও মা-ই নেয়। হয়তো এবার থেকে মা দিয়েও আসবে। খুব মন খারাপ হয়ে গেল। নিজের কাঁচা কাজের ওপর খুব বিরক্তি জন্মাল। এতটা ছড়ালাম আমি, ধুর! এবার থেকে তো বন্দী দশা। শেষে চ্যাটের ওপরেও খড়্গহস্ত না হয়। রাতে মা এল। ভয়ে ভয়ে ঘাপটি মেরে অঙ্ক বই খুলে বসে রইলাম। একটু পরে মা খেতে দিয়ে ডাকল। গুটিগুটি গিয়ে বসলাম। মায়ের কোনও হেলদোল নেই। সব নর্মাল। বাবার দিকে তাকালাম। বাবা তাকাল না, খবর দেখতে দেখতে খেতে লাগল। এবার মনে হল সত্যি মরেই গেলাম।