বাংলা দিবস

যখন ছোট ছিলাম, পয়লা বৈশাখে নতুন জামা পরার চল ছিলতখন দুবার নতুন জামা হতপুজো আর পয়লা বৈশাখ। আর দাদু নতুন নন্টে-ফন্টে কিনে দিত। বা অন্য কোনও বই। তবে মেনলি নন্টে-ফন্টে। সবার ছুটির দিন বলে ভাল খাওয়া-টাওয়াও হয়েছে। হালখাতার খাওয়া খাইনি যদিও কখনওকিন্তু মারাত্মক কোনও মাতামাতি হত নাটিভিতেও বাড়াবাড়ি রকমের ঘটাপটা হত নাসবাই যদিও তখন সরদিন ইংরিজি বলার প্রাণপণ চেষ্টা করত না, যে তার কনট্রাস্টে আজকের দিনটায় বাংলা বলবেআর হ্যাঁ, দাদু-ঠাকুমারা বাংলা সাল বলতে পারত কেউ কেউ কিন্তু আমরা বাকিরা এই একটা দিনের জন্যে সেটা বলতে পারার কুইজটাতে অবশ্যই মজতাম নাযে সালটা ধরে রোজ কাজ চলে, সেটা নিয়ে গর্বও ছিল না, লজ্জাও নাআর যেটার দরকার পড়ছে না, এই একটা দিনের জন্যে সেটা রিসার্চ করে (ইং-বং ক্যালেন্ডার দেখে, গুগল করে না) খেলা দেখানোর কোনও চল ছিল না।

প্রথম টিউশন কাটা

আমি তখন সবে মাধ্যমিক দিয়েছি। টিপিকাল বাঙালির মত আমারও ওই তিন মাস বিবিধ টিউশনে দৌরাত্ম্যি করেই কাটছে। আমার বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা ভয়ানক সীমিত। তার ওপর তারা কেউ আশেপাশে থাকেও না। মেয়েদের স্কুলে পড়তাম বলে তারাও সবাই মেয়ে। তার মধ্যে আমি একটু বেশি ঘরকুনো। সব মিলিয়ে ঘরে-বাইরে ইমেজটা এক্কেবারে নিরীহ গোবেচারা। এমনিতে বাবা-মা-ভাইয়ের ওপর দিব্যি দাপট চলে ঠিকই, কিন্তু সেসব সামান্য টিভি, কম্পিউটার, গল্পের বই কেন্দ্র করেই। আর মাঝেমধ্যে ওই ছুটির তিনমাস পড়াশোনা ত্যাগ করার মৌলিক অধিকারের দাবিতে। এর বেশি কিছু নিয়ে কথা বলার আমার দরকারই পড়ে নাএই নিরীহতার সুবিধে হল বাড়ির যে টিউশন ছাড়া একা বেরনোর নিষেধাজ্ঞা ছিল এবং পড়তেই যে যাই সেটা যাচাই করতে যে ওরা আনতে যাবার নিয়ম রেখেছিল, সেটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। তাই অবলুপ্ত না হলেও শিথিল নিয়মরক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

শ বাবু #৬

ওই কথা শোনার পর মা যথেচ্ছ শাসন করল, বাবা প্রথমে নাক গলাল না (সম্ভবতঃ ওই শাসনটা ডিজার্ভ করি ভেবেছিল)। তারপর বাবা জানতে বসল ঠিক কী হয়েছিল। বললাম। ইতিমধ্যে বাবার সাথে লোকটার কথা হয়ে গেছে এবং আবার আসবে। আমি যেন পারতপক্ষে ভব্যতা বজায় রাখি সে বিষয়ে কিছু বলল-টলল, আমি বিশেষ কান দিইনি। কিন্তু কথা হল, সময় ভাগ করা হবে সব সাবজেক্ট-এর জন্যে, এবং মুখস্থ করা নিয়ে বেশি চাপ নিতে হবে না। কিন্তু লোকটা এখনও দূর হল না।
পরেরবার যখন এল, ততক্ষণে আমি আমার চোয়াল শক্ত করে রেডি, কথা না বলে যথাসম্ভব প্রকাশ করার চেষ্টা করছি যে আমি একটুও অনুতপ্ত নই। অ্যাডিশনাল করা হবে স্থির হল। খানিকটা হিজিবিজি করেই আবার কম্পাল্সারি ম্যাথ, না হলে ফিজিকাল সাইন্স। বেশ, এটা রিপোর্ট করতে হবে। আরও দিন খানেক এরকম গেল। প্যাটার্ন পেয়ে গেলাম। অ্যাডিশনাল করতে হলেই খুব আপত্তি থাকে লোকটার। এই সুযোগ তো ছাড়া যাবে না। অতি অবশ্যই ঘন ঘন আমার অ্যাডিশনাল পরীক্ষা থাকতে লাগল। ১০০-র বেশি-ই হবে। অ্যাডিশনাল করতে হলেই লোকটা এক্সট্রা ঝিমিয়ে থাকে। খুবই ভাল ব্যাপার। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে নিয়ে গেলাম যে আবার একদিন হঠাত্‍ এল না।

শ বাবু #৫

দিন যায়। তিনদিন টাইম হবে না বলে ২ ঘন্টার বদলে ৩ ঘন্টা লোকটার ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে হয়। "কঠোর বিদ্যাভ্যাস" আয়ত্তের অজস্র "টোটকা" শুনি। কেমন লোকটার সাক্সেসফুল কেরিয়ারের পেছনে পাখাবিহীন চিলেকোঠায় বাইরে থেকে শেকল তুলে বন্দী থাকার অবদান সবচেয়ে বেশি। কেমন রামকৃষ্ণ মিশনের ঠেঙানির অবদান তার পরেই। ইতিমধ্যে আমার হাতের লেখা পাল্টে ওর মত করে ফেলতে হয়েছে (যেটা কিনা হুবহু এরিয়াল ফন্ট, নো কার্সিভ্ অ্যালাওড)। পরীক্ষা যে শেষ হয় না, বলাই বাহুল্য।

শ বাবু #৪

আমার বাড়িতে এমনিতেই টিউটরকে খাওয়ানোর চল আছে। তার ওপর নাকি সেএএএএএই রাজাবাজার থেকে সোজা আমাদের বাড়ি আসে। নিত্য মা টোস্ট-অমলেট-চা কিম্বা লুচি-তরকারি খাওয়াতে লাগল আর প্রবল আহা-উহু করতে থাকল। লোকটাই হিরো। আমি একটা বাজে অব্স্ট্যাকল। ইতিমধ্যে আমি নাইনে উঠে গেলাম আর আমার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও একে অ্যাডিশনাল পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হল।
ইতিমধ্যে ভাইয়ের কপাল খুলে গেল। শ-বাবুও বলল ওকে আর পড়াবে না (ও নাকি খুবই ছোট) আর ওর বন্ধুদের দেখাদেখি ওকে ওর স্কুলেরই এক খোঁয়াড়ে পুরে দেওয়া হল এবং প্রথমে অনেক আপত্তির পর ও অচিরেই বাড়ির বাইরে, গ্রুপে পড়ার ফুর্তি বুঝে ফেলল।

শ বাবু #৩

এই বয়সে এসে অনেকগুলো টিউশন করিয়ে ফেলে নিজেকে আবার লোকটার জায়গায় কল্পনা করলাম। প্রতিবারের মত এবারও কুঁকড়ে গেলাম। আমার কারণে আমারই স্টুডেন্ট আমারই সামনে বসে কেঁদে দিলে আমি সম্ভবতঃ তক্ষুনি পালাব। আর কোনওদিন যে সে বাড়িতে পা রাখব না বলাই বাহুল্য। কিন্তু সবাই তো আমি নয়, এ তো নয়ই। দিব্যি বসে আমার কান্নার ওপর দিয়েই নোট দিয়ে যেতে লাগল, আর অবাক কান্ড, আমিও মিস করার ভয়ে লিখতেও লাগলাম! অতি অবশ্যই লেখানো হল নিউটনের ফার্স্ট ল।

“Everyobjectcontinuestobeinastateofrestorofuniformmotioninastraightlineunlesscompelledbysomeexternalforcetoactotherwise”! 

শ বাবু #২

ভাই বেরিয়ে গেল। আমার সন্দেহ হল এই ট্রমা কাটিয়ে উঠে ওর পক্ষে আর কোনওদিন হিন্দী গান গাওয়া সম্ভব হবে না। আরেকদিকে মনের ভেতর সুনামিক প্রশ্ন যে হিন্দী গান গাইলে কী হয়। কিনতু এ যা জিনিস! একে জিজ্ঞেস করলে নির্ঘাত ব্রহ্মতেজে ঝলসে দেবে। আমি চুপচাপ ‘নোট’ নিতে লাগলাম আর আড়চোখে দেখতে লাগলাম। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ইচ্ছে হল।
যখন প্রথমবার শুনেছিলাম এবার দিদিমণির পরিবর্তে স্যার, দেদার পুলক হয়েছিল। কে না জানে টিউশন স্যারেরা ভবিষ্যৎ প্রেমিক হয়। বাবার সাথে যেদিন কথা বলে গেল, উঁকি ঝুঁকি মেরেও বেশি কিছু দেখতে পেলুম না। কৌতুহলের মত জিনিস নিবৃত্ত না হলে যা হয়। উত্তেজনা আর কল্পনা পাল্লা দিতে লাগল। প্রথমে ভাইকে পড়াবে শুনে খুব খুশি হলুম। অবজ়ার্ভেশনের পক্ষে খুবই অনুকূল সংবাদ। লোকটা এল একটা তালপাতার সেপাই। ফটফটে ফরসা। একটু সন্দেহ হল রোগা হতে হতে সী-থ্রু হয়ে গেছে কিনা। তা হোক, মনকে বোঝালাম। দেখতে নিয়ে ভাবে শ্যালোরা। কিন্তু গোটা সেশনটায় পাশের ঘর থেকে যা চাপা গর্জন আসতে লাগল পুরো বাড়া-ভাতে ছাই।

শ বাবু #১

টিউশন বস্তুটা আমার সাথে লেপ্টে গেল আমার ক্লাস সিক্স থেকে। আমার বেশির ভাগ সহযোদ্ধাদের থেকে কিছুটা দেরিতেই। কিন্তু আমার বাবা কিঞ্চিৎ সেকেলে বলে টিউশন এড়াচ্ছিল। বোধহয় নিজের একখানি তিক্ত অভিজ্ঞতাও একটা কারণ। কিন্তু একবিংশ শতাব্দিতে পা গলিয়ে মাধ্যমিকের গুরুত্বকে অস্বীকার করে, বোর্ড-সিলেবাসীয় প্যানিক উপেক্ষা করে সন্তান মানুষ করবে, এই ধক মানুষের ছিল না। আমার বাবারও না। মায়ের তো না-ই। অতএব অনেক খোঁজ-খবর-ঝাড়াই-বাছাইয়ের পর ধ-দিদিমণি নিয়োজিত হলেন। বেশ ভাল ছিল, অল্প বকত , কিন্তু আমার বাড়ির টীচারদের মধ্যে ওই বেস্ট! তার বছর দুই পর আবার একটা টিউটোরিয়াল। সেখানে দেদার বন্ধু ছিল, নিজের স্কুলের, অন্য স্কুলের … তারপরেই বাড়িতে একজন স্যার। এই প্রাণীটিকে নিয়ে কথা খরচ করা যেতেই পারে, কারণ আমার অতগুলো অভিজ্ঞতাকে একফুয়ে উড়িয়ে দিতে পারে ওই লোক।
যদি ভাল্লাগে...email-এ sign up করতে পারেন/পারো/পারিস, নতুন লেখা ছাড়া কিচ্ছু পাঠাবো না, promise...