বৃষস্কন্ধ

ভারতে স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর স্তরে কখনও শিক্ষকতা করি নাই তবে করিতে দেখিয়াছি। স্নাতক স্তর অবধি শিক্ষা আমি গ্রহণও করিয়াছি। শিক্ষকের কেহ ছিলেন রাশভারী, কেহ বা রাশভারী হইবার প্রয়াসী, কেহ বা অমায়িক, মিশুকে। আমি নিজে শিক্ষকতা করিব বলিয়া কোনওদিন ভাবি নাই ফলে তাঁহাদের তরফের আচরণের কার্যকারণ লইয়া ভাবিবার বিশেষ অবকাশ রাখি নাই। সেই সাথে এও বলিয়া রাখা ভালো যে আমার অনুপস্থিতির হারের উপর ভরসা করিয়া বলা চলে, এই কারণে তাঁহাদের বিরাগভজন হইলেও পীড়ার কারণ কখনও হই নাই।




ভাগ্যদেবতা যথারীতি অলক্ষ্যে বসিয়া মিটিমিটি হাসিয়াছিলেন। কালেক্রমে আমিও শিক্ষকতায় হাতে-খড়ি, থুড়ি হাতে-মার্কার করিলাম। তবে ঘটনাটি ঘটিল দেশের বাহিরে। এখানে ভারতীয় আচার-বিচার-মূল্যবোধ খাটে না। এখানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের তফাত আছে। দেশদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত হইবার আশঙ্কা সত্ত্বেও স্বীকার করিব, হেথায় ব্যবস্থাপনা তুলনামূলকভাবে উদার। শিক্ষক ছাত্রকে কোনও কিছু করিতে বাধ্য করেন না, ছাত্রও শিক্ষকের কাছে বেয়াড়া দাবি রাখে না। ছাত্র ও শিক্ষক নিজ নিজ কর্তব্য এবং কর্তব্যসীমা – দুই সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল। সাধারণতঃ উচ্চতারে বাঁধা আবেগের কারণে ভারতে যে ঔদ্ধত্য ছাত্র কিংবা শিক্ষক উভয়ের মধ্যেই মাঝে মাঝে লক্ষিত হয়, এদেশে তাহা ইয়েতির মতই বিরল। অন্তত তাহাই মনে হইয়াছিল। কিন্তু, বিজ্ঞান বলে ব্যতিক্রমই নিয়মের পরিচায়ক। বৃষস্কন্ধ আসিয়া সেই ব্যতিক্রমীর স্থলাভিষিক্ত হইল।

বৃষস্কন্ধকে পূর্বে বহুবার দেখিয়াছি ল্যাবে বসিয়া থাকিতে। কিন্তু তাহার সহিত আমার কোনওপ্রকার ভাববিনিময়ের অবকাশ ছিল না। বৃষ (তাহার চেহারা অপেক্ষা স্বভাবের সহিত বৃষের সাদৃশ্যের আধিক্য দেখিয়া সন্দেহ হইতেছে হ্রস্ব নামটিই অধিক সার্থকতা দাবি করিবে) চলতি বত্‍সরে মাস্টার্স লইয়া আমার ক্লাসে জুটিল। প্রথমদিন হইতেই তাহার চেষ্টা রহিল যে, সে যে কী অসম্ভব করিৎকর্মা তাহা একবার প্রমাণ হইয়া যাক, সকলে জানুক, সেই সর্বশ্রেষ্ঠ। সহপাঠী হইতে শিক্ষক-শিক্ষিকা জানুক ইহাকে পাইয়া তাহারা কী সৌভাগ্য ধারণ করিয়াছে। দুর্ভাগ্যবশতঃ সে সুযোগ তাহার জুটিতেছিল কম। যেটুকুও জুটিতেছে, তাহার সদ্ব্যবহার করিবার আয়োজন ও চেষ্টা, উপলক্ষকে ছাপাইয়া গিয়া সমস্ত ব্যাপারটিকে জোলো করিয়া দিতেছে। এমনভাবেই চলিতেছিল।

কাজের মধ্যে তাহাদের ল্যাবের এক্সপেরিমেন্টগুলি শেষ করিয়া লগবুকে লিপিবদ্ধ করিবার ভার ছিল।সময় অতি সংক্ষিপ্ত : তিনমাসেরও কম। তাহারই মধ্যে উক্ত খাতাখানিতে প্রতিটি এক্সপেরিমেন্ট করিয়া তাহার ভুল, তাহার সংশোধনপ্রণালীসহ সঠিক করিয়া লিখিতে হইবে। ইহা সাধারণতঃ ভারত ও তাহার সংলগ্ন দেশগুলির ধরণ নহে, ফলে ইহা সেসব দেশ হইতে আগত ছাত্রকুলের পক্ষে বুঝিয়া লওয়া অথবা বুঝাইয়া উঠা – উভয়ই কঠিন। এর প্রধান কারণ, উক্ত দেশগুলিতে ল্যাবের খাতা হইতে হয় গোছানো ও ত্রুটিবিহীন। কাজ করিবে আলাদা খাতায় ও পরে নিপুণভাবে, সুছাঁদ হস্তাক্ষরে পুনর্মুদ্রণ করিবে আসল খাতায় – ইহাই দস্তুর (ঝিকিমিকি কালির কলম ব্যবহার করিলে বোনাস)। এই কারণেই আমাকে একখানি পুরাতন বত্‍সরের লগবুক উদাহরণস্বরূপ প্রথম কয়েকদিন সঙ্গে রাখিতে হয়। যবে হইতে আমি ল্যাব করাইতেছি, আমার নিজের খাতাখানিই সঙ্গে লইতাম। তাহাদের দেখানোর কাজও হইত, এবং কী সমস্যার কী সমাধান করিয়াছিলাম, নিজেরও দেখিয়া লইতে সুবিধা হইত। এই কারণে আমার লগবুক প্রতিদিনই আমার সঙ্গে ক্লাসে যাইত। সেবার তৃতীয় বত্‍সর চলিতেছিল। ইতিপূর্বে কোনও অপ্রিয় ঘটনা ঘটে নাই।

কিন্তু বৃষ অন্যদের তুলনায় আলাদা। প্রথমদিনেই সে আমার খাতার প্রতি পৃষ্ঠার ছবি তুলিয়া লইতে উদ্যত হইল। হুবহু টুকিয়া দিলেই যে হুবহু আমার নম্বরখানি জুটিবে না, বরং টুকিবার জরিমানা দিতে হইবে, বৃষের মস্তকে তাহা আঁটে নাই। বারণ করিতেই বৃষ রীতিমতো তেড়িয়া উঠিল। তাহাকে অতিকষ্টে নিরস্ত করিয়া বলিলাম যে কেন তাহার রাগিবার কথা নয়। যদি কাহারও রাগিবার কোনও কারণ ঘটিয়া থাকে তো সে আমি। বৃষ অতঃপর ইহাকে আমার ঈর্ষা ভাবিয়া লইয়া সেদিনের মত ক্ষান্ত হইল।

ইহার পর একাধিকবার বৃষর সহিত আমার কম-বেশি কথা কাটাকাটি লাগিয়াই থাকিত, তবে তাহা আমি যথাসাধ্য অল্পের উপর দিয়াই উতরাইবার চেষ্টা করিয়াছি। তাছাড়া খোঁজ লইয়া দেখিয়াছি, আমার সহিত বলিয়াই নহে – বৃষ স্বভাবতই এমন। ল্যাবের সহকারীকে মনুষ্য বলিয়া গ্রাহ্য করা তাহার কর্তব্যের মধ্যে সে ধরে না। এমন ভাবনার জন্য অবশ্য তাহাকে অধিক দোষারোপ করিতে পারি না; ভারতে (ও তত্‍সংলগ্ন দেশগুলিতে) এই বিরক্তিকর প্রবণতা আমার বাবার আমল হইতেই আছে বলিয়া শুনিয়া আসিয়াছি। কিন্তু এই দেশটিতে বৃষ তিন বত্‍সরকাল অতিবাহিত করিয়াও সেই স্বভাব ত্যাগ করিবার কোনও চেষ্টা দেয় নাই, ইহাই আশ্চর্যের।

ইতিমধ্যে এক্সপেরিমেন্ট ক্রমশ কন্সেপচুয়াল হইয়া উঠিতেছে, এবং বৃষ সপ্তাহ দুয়েক হাজিরা না দিয়া হঠাত্‍ উদয় হইয়া সামাল দিতে বেগ পাইতেছে। তাহার মনে হইল খাটনি এড়াইয়া যদি নম্বর হস্তগত করা সম্ভব হয় তো বেশ হয়। সে সটান আসিয়া আমার লগবুকখানি দাবি করিল। ইতিমধ্যে (বৃষের দেখিয়াই বোধকরি) বাকি অর্ধষণ্ডগুলিও আমার লগবুক দাবি করিয়া করিয়া তাহাকে অর্ধমৃত করিয়া তুলিতেছে এবং স্বচেষ্টা এড়াইয়া চলিতেছে দেখিয়া আমি লগবুক আনা বন্ধ করিয়াছিলাম।

বৃষকে জানাইলাম, আনি নাই। শুনিয়া সে আমাকে একবার আপদমস্তক মাপিয়া লইল। তাহার (অন্তত) ৫'১০” এর কাঠামোতে ৫৬” বত্‍ ছাতিকে অগ্রাহ্য করিবার সাধ্য আমার কুলাইবে না জানিয়াও যথাসম্ভব গাম্ভীর্য বজায় রাখিবার চেষ্টা করিয়া পাল্টা কটমট করিয়া তাকাইলাম। বৃষ ততক্ষণে আমার চারপাশে দৃষ্টি বুলাইয়া লগবুক না দেখিয়া হুকুম করিল পরদিন যেন অবশ্যই লইয়া আসি।

আনা সম্ভব হইবে কিনা, আনিতে আমি রাজি আছি কিনা, আনা আমি প্রয়োজন মনে করিব কিনা, এসব প্রশ্ন তাহার কাছে অবান্তর বোধ হইল। সম্ভবত তাহার শিং ডিঙাইয়া এসব যুক্তি তাহার মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছিতে পায় নাই। ইহা আনাআনি যে আমার স্বেচ্ছাধীন এবং আমার সেই ইচ্ছার ওপর প্রভাব খাটাইবার জায়গায় যে সে নাই, তাহা সে বোঝে নাই। অনুরোধে যদি বা কার্যোদ্ধার হইলেও হইতে পারিত, ঔদ্ধত্যে যে তাহা একেবারেই হইবে না, ইহা সে উপলব্ধি করে নাই। বোধ করি চিরদিন গায়ের জোর খাটাইতেই সে অভ্যস্ত। বলিলাম মনে থাকিলে আনিব'খন। সামান্য বুদ্ধি থাকিলেই বৃষ বুঝিত যে, কেহ যখন আগেভাগেই অজুহাত সাজাইয়া দিতেছে, সে প্রকারান্তরে তিক্ততা এড়াইয়া এবং বৃষেরই সম্মান বাঁচাইবার জন্য না বলিতেছে। কিন্তু সে বুদ্ধি বৃষ পোষে নাই। সে আমাকে নিশ্চয় করিয়া আনিতে বলিয়া গেল।

পরদিন যথারীতি আমি লগবুক আনিলাম না। বেশ বুঝিলাম কেন আনি নাই, ইহা লইয়া বৃষের সহিত একটি বিতণ্ডা হইবে এবং ঘটা করিয়া তাহাকে বুঝাইতে হইবে। আমার যে প্রথম দুইদিনের বেশি আনিবারই কথা নহে, বরং আমি যে আনিয়া আনিয়া তাহাদের সুবিধা দিয়াই আসিয়াছি, উহা যে তাহার দাবির জিনিস নহে, তাহা বুঝাইবার জন্য মনে মনে মহড়া দিতেছি। বৃষ আসিয়াই লগবুক দাবি করিল। বলিলাম, আনি নাই। মনে মনে তাহার “কেন”র উত্তর লইয়া প্রস্তুত, সে কিন্তু সেদিকের ধারও মাড়াইল না। ছাতি ফুলাইয়া চড়াও হইয়া আদেশ করিল যেন তত্‍ক্ষনাত্‍ লইয়া আসি।

ঘরের প্রতিটি প্রাণী সমবেত শ্বাস টানিয়া উত্‍কর্ণ হইয়া নিজ নিজ স্ক্রীনে দৃষ্টিবদ্ধ হইয়া বসিল। আমার পাশে আমারই সহকর্মী, একই ল্যাবের দায়িত্বে থাকে, বৃষের স্পর্ধায় অবাক হইয়া তাকাইল। আমিও অবাক হইয়া বৃষের মুখখানি নিরীক্ষণ করিলাম। এই যে গোটা ল্যাবের ছন্দটি পতন হইল, তাহা কী সে বুঝিতে পারিল আদৌ? কোনও লক্ষণ দেখিলাম না।

পরবর্তী আধটি ঘন্টা যে বচসা হইল, তাহা শেষ হইল বৃষের এই দাবিতে যে আমি (ও আমার সহকর্মী মিলিতভাবে) বৃষের সহিত অসহযোগিতা করিয়া তাহার সময় নষ্ট করিয়া নম্বর কমাইয়া দিবার ষড়যন্ত্রে মাতিয়া উঠিয়াছি। অবশেষে শত চেষ্টা করিয়াও যখন সে তাহার সমস্যাটি বুঝিতে চাহিল না, স্থির করিল সে লেকচারারের দ্বারস্থ হইয়া ইহার রফা করিবে। ভবিলাম, ইহা করিয়া অবশেষে ক্ষান্ত দিবে। কিন্তু ষণ্ড রাগিলে তাহা খন্ডায় কে! স্রেফ নিজেকে সঠিক প্রমাণ করিতে বৃষ তাহার সহিতও ঝগড়া করিল। শেষে এমন পর্যায়ে যাইল যে বৃষকে জিজ্ঞাসা করিতে হইল, সে কোর্স চালাইবার নিয়ম লইয়া প্রশ্ন তুলিতেছে কিনা। তাহাতেও যখন হইল না, বৃষ ক্লাসে, ল্যাবে, সর্বত্র আসা বন্ধ করিল। শুনিয়াছিলাম, আমাদের ঘাড়ে দোষ চাপাইয়া ছাত্র ইউনিয়নে ব্যাপারটি লইয়া যাইবার উদ্যোগ করিতেছে।

এখনও পর্যন্ত সেখান হইতে ডাক পাই নাই, তবে খাতা জমা করিবার দিন বৃষ আসিয়া আমার সহকর্মীকে খাতা দিয়া গিয়াছে, এবং বলিয়াছে যে সে নিজেই করিয়া লইয়াছে। ভালোই করিয়াছে দেখিলাম।
যদি ভাল্লাগে...email-এ sign up করতে পারেন/পারো/পারিস, নতুন লেখা ছাড়া কিচ্ছু পাঠাবো না, promise...