অ্যালেন

শনিবারের ফুটফুটে বিকেল। ৪:৪০ বাজে। ইয়র্ক মিন্সটারের গায়ের একাধিক সর্পিল গলির একটা গলি। প্রায় দক্ষিনেশ্বরের গায়ে যেমন অজস্র গলি আছে, কচুরি-মিষ্টি-শাঁখা-পলা-পেটমোটা শিব-মশা তাড়ানোর ব্যাট-আর-যাহা-কিছু সবই পাওয়া যায়, ওরকমই একটা গলি। এটায় প্রধানত সার দিয়ে খাবারের দোকান। রোমানদের তৈরি শহর বলে এটা বাকি ইংরেজ শহরদের থেকে আলাদা। যাইহোক সেটা আজকের কথা নয়। কথা হল, ওই খাবারের গলিটায় ফিশ অ্যান্ড চিপ্স বাগিয়ে আমি দোকানের উল্টোদিকে মিন্সটারের গায়েই একটা সীটে, রোদে বসে খাচ্ছি।




খিদে পেয়েছে খুব। খিদের তাড়নায় শীতও বেশি করছে। ঝোঁকের মাথায় বেরিয়ে পড়ে লাঞ্চ হয়নি, শেষ খেয়েছি ব্রেকফাস্ট, সকাল ৯টায়। গিলছি রীতিমত। আর ক্রমশ যেন নিজের প্রত্যন্ত অঙ্গগুলোয় সাড় ফিরে পাচ্ছি। অর্ধেকটা খাবার শেষ করে ফেলে অবশেষে খাওয়ার ফাঁকে এদিকে ওদিকে তাকানোর অবসর পাচ্ছি। শনিবারের বাঁধা ছকে খুদে ছেলে বাবার কাছে বায়না করছে। সদ্যপ্রাপ্তবয়স্করা হইহই করে ঘুরছে, সন্ধে হবার অপেক্ষায়। মাঝবয়সী বাবা-মায়েরা প্রাণপণ পালানো বাচ্চার হাত ধরে রাখার চেষ্টা করছে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ধীরে ধীরে লাঠি ঠুকে ঠুকে ঘুরে ঘুরে রোদ পোহাচ্ছে। যে বয়সের যা রীতি। ঠান্ডা থাকলেও সে যে আর বেশিদিন নেই, এই ফুর্তির মেজাজে সকলেই ফুরফুরে। এদেশে শনিবারের মত দিনে রোদ পাওয়া গেছে এই আনন্দেই প্রায় সবাই আত্মহারা। আমি বরাবরই সাইডলাইনে থেকে এসব দেখতেই ভালোবাসি বেশি। সেভাবেই তৃপ্তি সহকারে বিকেলটা পোহাচ্ছি।

আমার সামনে এক ঝাঁক পায়রা। ঝাঁক ঠিক নয়, খান পাঁচেক হবে, তবে আমার পক্ষে ওটাই বিশাল ঝাঁক। কারণ আমি পায়রা একটু ভয়ই পাই। মানে, ঠিক ভয় না, কিন্তু ওদের ওই ঠিকরানো চোখ, আর মানুষের মধ্যে নির্ভয়ে, ডাঁটের সাথে অবাধ বিচরণ করতে করতে হঠাৎই খামকা চমকে উঠে অতর্কিতে ঝটপটিয়ে উড়ে যাবার চেষ্টাটার আচমকা-ভাবটা ভয় পাই। তাই ওদের একটু চোখে চোখে রাখি। ওরা যেভাবে ঠুকরে ঠুকরে, উড়িয়ে উড়িয়ে খায়, আপাতত ওইভাবে এক টুকরো রুটি নিয়ে একে অপরকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ডানদিক থেকে একটা ছেলেমেয়ের দল আসছে। সবাই কুড়ি-বাইশের এর মধ্যে। ওরা একটু বেশি হইহই করছে। আমার সামনে দিয়েই যাবে আরেকটু পরেই। আর বড়জোর তিন হাত দূরে।

তারপরেই কান্ডটা ঘটে গেল। সেটা হতে লাগল হয়তো বড়জোর দশ সেকেন্ড, কিন্তু আমার চোখের সামনে আমি যেন এখনও অ্যাকশন রিপ্লে দেখতে পাচ্ছি। ওই দলের একটা মেয়ে, ছোট্ট বাচ্চাদের মত হইহই করে এগিয়ে এল পায়রাগুলোর মধ্যে। পায়রাগুলো চমকে উঠে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে লাগল – যেমনটা হয়ে থাকে। সরু গলি, বেশিদূর যাবার নেই। কিন্তু তক্ষুণি ওদেরই দলের একটা ছেলে ছুটে এসে একটা পায়রাকে টার্গেট করে সপাটে একটা পেনাল্টি কিক মারল।

'ভট' করে চামড়ার বলে লাথি লাগার মত একটা আওয়াজ হল। আর তারপরে দমবন্ধ হয়ে, যেন স্লো-মোশনে দেখতে পেলাম বাকি পায়রাদের ঝটপটিয়ে উড়ে যাবার মধ্যেই লাথি-খাওয়া পায়রাটা এপার থেকে উড়ে ওপারে গিয়ে স্টাফড টয়ের মত থপ করে গিয়ে পড়ল, ঘাড় গুঁজরে, ভয়াবহ তালপাকানো ভঙ্গিতে। ততক্ষণে এদের দলের একটা মেয়ে "অ্যালেন?!" বলে চেঁচিয়ে উঠেছে।

আচম্বিতে হল বলেই হোক, ঝামেলায় জড়াবে না বলেই হোক, পায়রা একটা মনুষ্যেতর জীব বলেই হোক, সভ্যতার নিদর্শন দেখিয়ে ওর দলের লোকই যখন শাসন করছে, আমার আর কিছু বলা সাজে না – এই মর্মেই হোক, বা এই কারণগুলোর বিভিন্ন পার্মুটেশন-কম্বিনেশনেই হোক, সকলে প্রায় যেমন চলছিল চলতে লাগল। আমিও তাদেরই একজন। যারা দেখেছে প্রায় সকলেই বিচলিত, কিন্তু সকলেরই কাজ আছে, যে যেমন হাঁটছে হাঁটতে থাকল। যারা বসে ছিল, নিজের কথায় ফিরে গেল। তা ছাড়া পায়রা এখানে কাকের মতই গিজগিজে। শুধু কাকের মত চটপটে নয় বলে কত পায়রা উইন্ডশিল্ডে ধাক্কা খেয়ে বা চাকার তলায় পিষে পড়ে থাকে এভাবেই। ও নিয়ে কেই বা ভাবে। দেখে সবাই কষ্টে চোখ ফিরিয়ে নিই। কিন্তু আজকের কান্ডটা তো অ্যাক্সিডেন্ট নয়? উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঘটাল ছেলেটা। আমার পক্ষে আর চোখ সরানো সম্ভব হচ্ছে না। পায়রা ভয় পাই, পুষব না কোনওদিনই। একখানিকে হাতে তুলে ধরার আগে আমার হার্টটাই ফেল করে যাবে। তবু, ওকে ওর সাথে যা হল, সেটা নৃশংস। ওর ওভাবে পড়ে থাকাটা আমি চেয়েও থাকতে পারছি না, আবার এড়ানোরও সাধ্যি নেই।

কতক্ষণ ধরে ওকে ফিরে ফিরে দেখছি তার সময়ের হিসেব আর নেই। প্রতিটা সেকেন্ড অনাবশ্যক রকমের দীর্ঘ মনে হচ্ছে। খাওয়ার ক্ষমতা নেই আমার আর। খিদেটাই চলে গেছে। হাতে বাক্সর ভারটা অল্প অল্প খেয়াল হচ্ছে, কিন্তু হাতটা যেন অন্যের মনে হচ্ছে। ও অল্প অল্প নড়ে উঠল কি? হ্যাঁ ওই তো, নড়ছেই। পাশ দিয়ে মানুষ গেলেই আবার স্থির হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নড়ছে ঠিক। তবে তো বেঁচে আছে! যাক! একটা নিশ্বাস পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হল প্রায় দম আটকেই বসেছিলাম। আর তার মানে বেশিক্ষণ হয়নি। ও ওঠার চেষ্টা করছে। আমার কি সাহায্য করা উচিত? কিন্তু আমি কীই বা করব। আর কিরকমই বা দেখাবে হঠাৎ? কিন্তু আমায় কেমন দেখাবে এটা কি এখন আদৌ আমার ভাবার কথা? আমার মানবিকতা কি আগে নয়? কিন্তু ও কি আমার মত আরেকটা দুপেয়েকে আর বিশ্বাস করবে? নাকি আঁতকে উঠবে আবার? কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছি না, তারই মধ্যে ও উঠে পড়ল। টলোমলো পায়ে দাঁড়িয়ে।

আমার আনন্দ হচ্ছে, না কষ্ট হচ্ছে, জানি না। ও মরে যাবার ভয়টা পুরোপুরি কেটে গিয়ে ভাবছি এইভাবে বেঁচে ও কেমন থাকবে। ডানাগুলো উদ্ভটভাবে কেতরে রয়েছে। ভেঙে যাওয়া অসম্ভব না। ও টলতে টলতে গলির এপারে এগিয়ে আসছে, তবে আমার দিকে না, আরও বাঁদিকে। বারে বারে ভয় করছে এই বুঝি পড়ে গেল। কিন্তু পড়ল না। একটা লাল গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, তার তলায় নিজেকে লুকিয়ে নিল। ভীষণ কষ্ট হল আমার। কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু কী? জানি না। ওকে কি একটু জল দেওয়া উচিত? তা আছে আমার কাছে। যদিও গাড়িটার তলায় ইঁটের খাঁজে অল্প জল জমে আছে। কিন্তু ও কি পারবে খেতে? কিন্তু আবারও মনে হল ও মানুষদের থেকে লুকোতেই গাড়িটার তলায় গেছে। মানুষদের প্রতি বিশ্বাস তো ওর একেবারেই ঘুচে গেছে। এই ট্রমা ও কাটিয়ে ওঠার আগে ওকে আর ভয় পাওয়াতেও ইচ্ছে নেই।

নিজের খাবারের দিকে তাকালাম। ঠান্ডা হয়ে এসেছে। আমার খেতেও ইচ্ছে নেই, ফেলে দিতেও গায়ে লাগছে। অনাহারকে আমি খুব কাছ থেকে চিনি, খাবার ফেলা আমার দ্বারা হবে না। কোনওমতে মুখে ঠুসতে লাগলাম। গলা দিয়ে নামতেই চাইছে না। বারবার গাড়িটার তলায় তাকাচ্ছি। একবার হঠাৎ চোখে পড়ল গাড়িটার তলায় অন্ধকারের মধ্যেই অল্প আলোয় দেখলাম ও ঠোঁট ডুবিয়ে অল্প জল খেল। ভাবতে ভালো লাগছে যে ওরও হয়তো একটু হলেও সুস্থ বোধ হচ্ছে। জল টল খাচ্ছে। খাবার শেষ করে আমি উঠে পড়লাম। ওকে আর দেখা যাচ্ছে না। তবে আশা করি ওকে বেড়ালে-টেড়ালে খাবে না। ভেবেই খুব মন খারাপ হল। বেড়াল পায়রা খায়ই। ওটা প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু দিব্যি খাচ্ছিল-দাচ্ছিল, ঘুরে বেড়াচ্ছিল, বেড়ালের শিকার হওয়ার ভয় থেকে উড়ে পালাচ্ছিল – হঠাৎ বিনাদোষে একটা বর্বর দুপেয়ের জন্যে ওর বাঁচার স্বার্থে ওড়ার চেষ্টাটুকুর সুযোগ ওকে এভাবে হারিয়ে ফেলতে হবে, এটা সহ্য হচ্ছে না।

আক্রোশের চোটে মনে হল এক্ষুণি এই প্যাট্রোল পুলিশদের কাছে গিয়ে ওই অ্যালেনের নামে বলি। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলঃ প্রমাণ? প্রমাণ নেই আমার কাছে। তখন হইহই করে লোকও জড় করিনি। তার উপরে, একটা "না-মানুষের" জন্য, প্রমাণাভাবে, অন্যকে অযথা ফাঁসানোর মানহানির মামলা না আমার বিরুদ্ধেই ঠুকে বসে। তার ওপরে আমি এদেশের মানুষও নই। কিসে কী হয় তার কোনও আন্দাজও নেই আমার। এসব আন্দাজ কেই বা ভেবেচিন্তে রেখে বসে থাকে? কিন্তু রাত ১১টা অবধিও টের পেয়েছি খাবারটা গলার কাছেই বসে আছে। স্ফিঙ্কটার পেরিয়ে তখনও নামতে পারেনি।
যদি ভাল্লাগে...email-এ sign up করতে পারেন/পারো/পারিস, নতুন লেখা ছাড়া কিচ্ছু পাঠাবো না, promise...