যখন ছোট ছিলাম, পয়লা বৈশাখে নতুন জামা পরার চল ছিল। তখন দুবার নতুন জামা হত। পুজো আর পয়লা বৈশাখ। আর দাদু নতুন নন্টে-ফন্টে কিনে দিত। বা অন্য কোনও
বই। তবে মেনলি নন্টে-ফন্টে। সবার ছুটির দিন বলে ভাল খাওয়া-টাওয়াও হয়েছে। হালখাতার খাওয়া খাইনি যদিও কখনও। কিন্তু মারাত্মক কোনও মাতামাতি
হত না। টিভিতেও বাড়াবাড়ি রকমের ঘটাপটা হত না। সবাই যদিও তখন সরদিন ইংরিজি
বলার প্রাণপণ চেষ্টা করত না, যে তার কনট্রাস্টে আজকের দিনটায় বাংলা বলবে। আর হ্যাঁ, দাদু-ঠাকুমারা
বাংলা সাল বলতে পারত কেউ কেউ কিন্তু আমরা বাকিরা এই একটা দিনের জন্যে সেটা বলতে পারার
কুইজটাতে অবশ্যই মজতাম না। যে সালটা ধরে রোজ কাজ চলে, সেটা নিয়ে গর্বও
ছিল না, লজ্জাও না। আর যেটার দরকার পড়ছে না, এই একটা দিনের জন্যে সেটা রিসার্চ করে (ইং-বং ক্যালেন্ডার
দেখে, গুগল করে না) খেলা
দেখানোর কোনও চল ছিল না।
এইদিনটা নিয়ে সবথেকে যেটা ভাল্লাগত সেটা হল ছুটি পাওয়াটা। এমনিতে বাড়ি থাকলেই পড়তে বসা নিয়ে একটা তিতিবিরক্ত পরিবেশ থাকত কিন্তু ওইদিনটায়
এসব ঝামেলা কম করা হত। হয়তো কাজের দিন হওয়া সত্ত্বেও বাবা-সুদ্ধু সবাই বাড়ি থাকত বলে। এইদিনের রুটিন হল ব্রেকফাস্ট সেরে চান টান করে নতুন জামা পড়ে নাও। হয় দুপুরের খাবার আগে নিচে গলিতে খেলো, নয়তো সবে চড়কের মেলা
থেকে কেনা সম্পত্তিগুলো নিয়ে বসে যাও। দুপুরে ভালমন্দ খেয়ে যখন বড়রা ঘুম দেবে, তখন চুপচাপ আমের/কুলের/তেঁতুলের আচার কিংবা যত ধরণের
হজমি বাড়িতে আছে (প্রকাশ্য বা লুকনো) নিয়ে কোথাও ঘাপটি মেরে বসে গল্পের বইটা শেষ কর।
এগুলো এমনিতে রোববারেও হতে পারে, কিন্তু ওইদিন এগুলোর স্বাদ বেশি ভাল লাগবে। হয়তো এইদিনটা বছরে একবারই আসবে বলে।
বিকেলটা অবশ্যই গলিতে খেলা। সন্ধে হয়ে গেলে
বাবা সবাইকে নিয়ে বেরনোর শখ করত। বাবা পাঞ্জাবি পাজামা পরে বেরত। প্রতিদিনের মতই। আলাদা করে ওইদিন বলে না। মাও শাড়ি পরত রোজকার মতই। আমিও ফ্রক, আর ভাইও শার্ট-হাফপ্যান্ট। আলাদা করে বাঙালি পোশাক পড়তে হত না। কেউ কিছু মনেও করত না। বেরোলেই আইসক্রীম। আর বাবা ধোসা কিংবা
ফিশফ্রাইয়ের কোনও একটা বাছবেই, সেটাও খাওয়া হত। আর কেন জানি না, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই গড়িয়াহাটেই যাওয়া হত আর অদ্ভুত সব জিনিস কেনা হত। ন্যাপথলিন, জামা মেলার ক্লিপ, আরও কিসব হিজিবিজি। তবে কোনও কোনওবার মনে আছে বিকেল বিকেল বেরোলে লেক বা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালেও গেছি। লেকে দারুণ হাওয়া দিত আর আমরা পার ধরে হাঁটতাম আর হাঁপিয়ে গেলে বসতাম। ভিক্টোরিয়ায় গেলে খেলেওছি বাগানে। আমাদের মত আরও সব পরিবারও থাকত। সেরকম হলে ওইদিনগুলোয় ঝালমুড়ি, ফুচকা, ইত্যাদি সুখাদ্য খাওয়া হত। যা খুশি গল্প করা হত। তবে যাই হোক না কেন নটার মধ্যে বাড়ি ঢুকে পড়তে হবে। একটু পরেই খেয়ে কোনও একটা গল্পের
বই নিয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে ঘুমনো। তখন সত্যি এইদিনটাকে
খুব ভাল লাগত।
এখন আর আলাদা করে কিছু মনে হয় না। কলকাতায় না থাকলে
তো বটেই। বরং কলকাতায় থাকলে টিভি, কাগজ, রেডিও সারাদিন চেষ্টা চালিয়ে যাবে মনে করানোর। দিকে দিকে সব সেলিব্রিটিরা আটপৌরে শাড়ি বা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বাঙালি খাবার চাখবে। ডাব-চিংড়ি আর চিতলমাছের মুইঠ্যা বলতে শিখবে ও শেখাবে। চ্যানেলে-চ্যানেলে বাংলা-সংস্কৃতিমূলক কুইজ হবে। লোকে আবার সেসব দেখে নিজেকে চ্যালেঞ্জ করে ফেলে তড়িঘড়ি এসএমএস করে উত্তর পাঠাবে। সঞ্চালকরা "ছ"কে রিফাইন করে বলবে "ত্স" (যদিও এটা রোজই করে, আজকে একটু বেশি করবে)। এছাড়া সারাদিন ফোনে অজস্র মেসেজ আসবে। সংস্কৃতিমান বাবা-মা সন্তানকে সকাল সকাল ছবি আঁকতে বসিয়ে দেবে। তাতে কলাপাতা, ডাব-চিংড়িধর্মী মোটিফ আবশ্যিক। নিজে হয়তো আগের সপ্তাহ থেকে এইদিনটা টারগেট করে বর্ষবরণমূলক কবিতা নিয়ে লড়ে যাচ্ছিল, সেটাকে ফেসবুকের স্টেটাস মেসেজ বানিয়ে নিচে ছেলে-মেয়ের চিত্রশিল্প সমেত টুক করে ছেড়ে দেবে। তাতে ১০০টা লাইক জমতে না জমতেই মোচার ঘণ্টের ছবি। রাত্তিরে "আমি বাংলায় খানা খাই"-মার্কা কোনও রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে তার ছবি আপলোড করে তবে শান্তি। পুরোটাই
এত বিরক্তিকর যে মনে হবে সারাদিনটা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিই। লোকজন মিডিয়ার তালে তাল দিয়ে সারাদিন
এমন কোঁত্ পেড়ে পেড়ে বাঙালিয়ানা ফলাবে যে সারা বছরের
সাহেবিয়ানা পালানোর পথ পাবে না। কিন্তু পরদিন সকালে উঠে একটা
ফ্লাশেই সব হাওয়া।