শ বাবু #১

টিউশন বস্তুটা আমার সাথে লেপ্টে গেল আমার ক্লাস সিক্স থেকে। আমার বেশির ভাগ সহযোদ্ধাদের থেকে কিছুটা দেরিতেই। কিন্তু আমার বাবা কিঞ্চিৎ সেকেলে বলে টিউশন এড়াচ্ছিল। বোধহয় নিজের একখানি তিক্ত অভিজ্ঞতাও একটা কারণ। কিন্তু একবিংশ শতাব্দিতে পা গলিয়ে মাধ্যমিকের গুরুত্বকে অস্বীকার করে, বোর্ড-সিলেবাসীয় প্যানিক উপেক্ষা করে সন্তান মানুষ করবে, এই ধক মানুষের ছিল না। আমার বাবারও না। মায়ের তো না-ই। অতএব অনেক খোঁজ-খবর-ঝাড়াই-বাছাইয়ের পর ধ-দিদিমণি নিয়োজিত হলেন। বেশ ভাল ছিল, অল্প বকত , কিন্তু আমার বাড়ির টীচারদের মধ্যে ওই বেস্ট! তার বছর দুই পর আবার একটা টিউটোরিয়াল। সেখানে দেদার বন্ধু ছিল, নিজের স্কুলের, অন্য স্কুলের … তারপরেই বাড়িতে একজন স্যার। এই প্রাণীটিকে নিয়ে কথা খরচ করা যেতেই পারে, কারণ আমার অতগুলো অভিজ্ঞতাকে একফুয়ে উড়িয়ে দিতে পারে ওই লোক।
আমি তখন ক্লাস এইট ছেড়ে নাইনে ঢুকব-ঢুকব করছি। ভাইটাও ফোর থেকে ফাইভে উঠবে। বাবা ভাবল এক ঢিলে যদি দুই পাখি ম্যানেজ হয়। শ–বাবু এলেন। সেকি মারাত্মক সিভি তার! রামকৃষ্ণ মিশন পুরুলিয়া। রাজবাজার সাইন্স কলেজ। চলমান ব্রহ্মচারী। খুউউউব কড়া। মনে হল শাকাহারী হবে নির্ঘাত। যদিও বিএসসি পড়ে, দেখে মনে হয় একটা প্রাচীন বটগাছের ঝুড়ি (গাছটা নয় : খুব রোগা তো।) ভাইটা ওর কাছে একদিন পড়েই দেখলাম ১০ বছর বয়েস বাড়িয়ে ফেলেছে! নেক্সট দিন আমার টার্ন। সকল থেকেই গলা শুকিয়ে আসছে। বারেবারে থুতু গিলছি। ভাই বলেছে ও হাসেও না, হাসায়ও না। কী ভয়ঙ্কর! তারপর তো এল সেই মুহূর্ত। কলিং-বেল বাজল। ব্যাক্তি এলেন, বসলেন। বই চাইলেন। কী ভয়াবহ প্রেজেন্স লোকটার! কোনও হাসি নেই, বাড়তি কথা নেই। তরপরেই হঠাত্‍ই নিজের ব্যাগ থেকে একখান খাতা বের করে বলল “নোট নাও”। নিলাম। খাতাটা এক ঝলক দেখে নিল। তারপর বলল “মোটা বাঁধানো হার্ড-কভার খাতা কিনবে!” ভয়ে ভয়ে ঘাড় নাড়লুম। ইতিমধ্যে পাশে বারান্দা দিয়ে ভাই মনে হল বাথরুমের দিকে গেল। ওকে ঠিক মুক্ত বিহঙ্গ মনে হল। হ্যাঁ অতটা কাব্যিক ভাবেই মনে হল। দূরে কোথাও একটা গান চলছে। হামরাজের টাইটল ট্র্যাক। ভাই বারান্দা দিয়ে ফিরছে, আর মনে মনে বেখেয়ালে গানটা গুনগুন করছে। হঠাত্‍ লোকটা হুংকার দিয়ে উঠল। “এদিকে এস!” ভাই চমকে উঠে ঘরে ঢুকে পড়ল। আমার একটু হাসিই পেল। কিন্তু লোকটার মুখের দিকে তাকিয়েই হাসি শুকিয়ে গেল। ভাই বেচারা মুখ করে দাঁড়িয়ে।
“তুমি হিন্দী গান গাও?” আমার আবার হাসি পেল। ভাই কী বলবে বুঝতে পারল না। “উত্তর নেই যে? বাবা মায়ের সামনে তুমি হিন্দী গান গাও? লজ্জা করে না? বাড়িতে কিছু বলে না?”
“তুমি এক্ষুনি হিন্দী গান গাইছিলে না?” আমার আবার হাসি পেল। কিন্তু অভ্যেস হয়ে আসছে। চাপতে পারছি। ভাই তো অবাক। বলল না। ও নিজেও বোধহয় খেয়াল করেনি গুনগুন করছিল। “আবার মিথ্যে কথা!” আমি, ভাই, দুজনেই হতবাক এবং চুপ। আবার প্রশ্ন। এবার আমায়। ”ও গান করছিল না?” ঘটনাটা সত্যি। মিথ্যে বললে কী করবে, বলা যায় না। সম্মতিসূচক মাথা নাড়লুম। “তবে?” এবার আবার ভাইকে। আমি খুব কষ্টে ওর দিকে তাকালাম। ও অবাক আর অভিমান মিশিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। “কী? উত্তর দাও?”
“কিসের?” ভাইয়ের সাথে আমিও হতভম্ব।
“কিসের?! এই যে বাবা মায়ের সামনে গান হিন্দী গাও ওনারা কিছু বলেন না?” ঠাকুমার ঝুলি হলে লোকটার চোখ দুটো নির্ঘাত ভাঁটার মতন জ্বলত।
“মা তো নিজেও হিন্দী গান গায়। বাবাও গায়।”
লোকটা কী বলবে প্রথমে ভেবে পেল না। কিন্তু সে তো কয়েক মুহূর্ত। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে হুংকার পেরে বলে উঠল “এরপরও আবার মিথ্যে কথা! লজ্জা করে না? যাও এক্ষুনি পড়তে বসো! পরেরদিন তোমার ব্যাপারটা দেখছি আমি!”
যদি ভাল্লাগে...email-এ sign up করতে পারেন/পারো/পারিস, নতুন লেখা ছাড়া কিচ্ছু পাঠাবো না, promise...